চাঁদপুরে সড়ক ও জনপথের ২১ কোটি টাকার সড়ক প্রকল্পে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ
নিজস্ব প্রতিবেদক
০৯ অক্টোবর, ২০২৫, 10:22 AM
নিজস্ব প্রতিবেদক
০৯ অক্টোবর, ২০২৫, 10:22 AM
চাঁদপুরে সড়ক ও জনপথের ২১ কোটি টাকার সড়ক প্রকল্পে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ
চাঁদপুর জেলায় সরকারি অর্থায়নে চলমান একটি বড় মাপের সড়ক প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেছে ।প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পে মেরামতের কোনো কাজ না করেই সরাসরি কার্পেটিংয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ, যা সড়কের স্থায়িত্বকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। স্থানীয়রা এই অনিয়মের জন্য ঠিকাদার এবং সড়ক বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশের অভিযোগ তুলেছেন, এবং তদন্তের মাধ্যমে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এই ঘটনা সরকারি প্রকল্পগুলোতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার অভাবকে আরও একবার সামনে তুলে ধরেছে।
প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য অনুসারে, কুমিল্লা-লালমাই-চাঁদপুর-লক্ষ্মীপুর-বেগমগঞ্জ (আর-১৪০) সড়কের বাকিলা বাজার থেকে বাগাদি চৌরাস্তা পর্যন্ত ১৬.১৭৮ কিলোমিটার অংশে রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য এম/এস শহীদ ব্রাদার্স-এম/এস ওকে এন্টারপ্রাইজ জেভি-কে এপ্রিল ২০২৫ সালে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের মেয়াদ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত নির্ধারিত। কিন্তু বাস্তবে এই কাজটি একজন স্থানীয় ঠিকাদার ফারুখ মিদ্দা নামে এক ব্যক্তি ক্রয় করে বাস্তবায়ন করছেন। অভিযোগ উঠেছে যে, এই ঠিকাদারের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, নিজস্ব দক্ষ প্রকৌশলী বা নির্মাণ সামগ্রীও নেই। অধিকন্তু, অদ্যাবধি সাইটে তার নিজস্ব বলে কোনো কিছু উপস্থিত নেই, যা প্রকল্পের গুণগত মান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।
প্রকল্পের আওতায় নির্ধারিত কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে গর্ত মেরামত (৪৬.১ ঘনমিটার), ইটের ড্রেন (৫০০ মিটার), আরসিসি ড্রেন (১০০ মিটার), আরসিসি ওয়াল (৪০৬ মিটার), এবং কার্পেটিং (১৬.১৭৮ কিলোমিটার)। কিন্তু অভিযোগকারীদের মতে, এসব কাজের কোনোটিই এখনো শুরু হয়নি। ঠিকাদার ফারুখ মিদ্দা মেরামতের কাজগুলো সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র কার্পেটিংয়ের প্রস্তুতিতে করেছেন, যা সড়কের দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে। উদাহরণস্বরূপ, পুরো সড়কে ৫টি স্থানে মোট ৪৭৫ মিটার লম্বায় ৬ ইঞ্চি পুরুত্বের বেইজটাইপ-১ দ্বারা ২ লেয়ার কার্পেটিং সহ রিপেয়ার কাজ নির্ধারিত থাকলেও, শুধুমাত্র বাকিলা (৬৮ মিটার) এবং ওয়্যারলেস বাজারে (৪৪ মিটার) নিম্নমানের পাথর ব্যবহার করে নামমাত্র 3 ইঞ্চি কম থিকনেস দিয়ে ১১২ মিটার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এই কাজে পাথরের চেয়ে বালু বেশি ব্যবহার করা হয়েছে এবং কালো পিচ যুক্ত রাস্তার বড় বড় ভাঙ্গা মালামাল সহ রাস্তার রোলার করা হয়েছে সাথে বালু মিশ্রণ করে যেখানে পাথর দেওয়ার কথা ছিল বলে অভিযোগ, যার দুটি স্থানের ছবি সংযুক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাকি ৩৬৩ মিটার কাজ সহ সড়কের উচু-নিচু অংশগুলোতে কোনো কার্পেটিং কাজ না করার পরিকল্পনা করেছে ঠিকাদার। সংশ্লিষ্ট উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান (চাঁদপুর) এবং সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন (কুমিল্লা জোন, অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী, চাঁদপুর) এই অনিয়মে জড়িত বলে অভিযোগ। লোকমুখে শোনা যায় যে, এই দুই কর্মকর্তা ইতোমধ্যে ঠিকাদারের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা গ্রহণ করেছেন। গোপন সূত্র থেকে জানা যায়, ঠিকাদার উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে ব্যবহারের জন্য একটি গাড়ি উপহার দিয়েছেন, এবং দুই কর্মকর্তার বাজার থেকে শুরু করে সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছেন। এর প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, উপ-সহকারী প্রকৌশলী যান্ত্রিক বিভাগের দায়িত্বে থাকায় সরকারি গাড়ি ঠিকাদারের সাইটে ব্যবহারের সুবিধা দিচ্ছেন। বাস্তবে, ঠিকাদারের নিজস্ব বা লিজকৃত কোনো যন্ত্রপাতি নেই, কিন্তু সরকারি রোলার, পেলোডার সহ ৫টি গাড়ি গত চার মাস ধরে কোনো প্রকার আবেদন বা রাজস্ব আদায় ছাড়াই হরহামেশা ব্যবহার হচ্ছে। এই কর্মকর্তারা এই সুবিধার বিনিময়ে নিজেদের পকেট ভর্তি করছেন বলে অভিযোগ, যা কর্মকর্তা-ঠিকাদারের যোগসাজশের স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।
প্রকল্পে আরও অস্বচ্ছতা দেখা যায় সাইট ল্যাবরেটরি, সার্ভে ইকুইপমেন্টের মতো অত্যাবশ্যক সুবিধা স্থাপন না করায়, যা নির্মাণের গুণগত মান এবং স্বচ্ছতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী তার অতিরিক্ত দায়িত্বের কারণে সপ্তাহে মাত্র দুই-একদিন সাইটে আসেন, এবং ঠিকাদারের সাথে আর্থিক ভাগ-ভাটোয়ারা করে চলে যান বলে খবর। অভিযোগ রয়েছে যে, প্রকল্পের বাকি কাজ না করেই শুধুমাত্র লোক দেখানো কিছু কাজ করে অসম্পূর্ণ কাজের হিসাব ভাগ-ভাটোয়ারা করবেন ঠিকাদার ফারুখ মিদ্দা, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন এবং উপ-সহকারী মোসতাফিজুর রহমান। এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র উল্লিখিত ১১২ মিটার বেইজটাইপ কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ সম্পন্ন হয়নি, এবং অবশিষ্ট কাজ নির্ধারিত সময়ে সম্পূর্ণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এমতাবস্থায়, সরকারি অর্থের লুটপাটের পায়তারা চলছে বলে স্পষ্ট, এবং বিল তোলার সময় অসম্পূর্ণ কাজ রেখেই বিল তুলে নেবেন এই ঠিকাদার।
স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন, মেরামত ছাড়া সরাসরি কার্পেটিং করলে সড়কটি কয়েক মাসের মধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে, যা সরকারি তহবিলের চরম অপচয় হিসেবে গণ্য হবে। সড়ক বিভাগ, চাঁদপুর এবং ঠিকাদারের পক্ষ থেকে এই অভিযোগগুলো নিয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি, যা অনিয়মের সন্দেহকে আরও জোরালো করে তুলেছে। স্থানীয়রা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলেছেন। সরকারি প্রকল্পগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ এখন জরুরি হয়ে উঠেছে, অন্যথায় এমন অনিয়ম দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে।